একটা কথা আমরা প্রায়শই শুনি ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের সাথে কথা বলার সময় এবং পরিসংখ্যানগতভাবেও বিভিন্ন সার্ভেতে দেখি যে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ মাত্রই আদতে তুলনায় সুখী মানুষ আমরা যারা অবিশ্বাসী তাঁদের থেকে। কথাটি আসলেই একজন অবিশ্বাসী নাস্তিকের পক্ষে বড় ভাবনার বিষয়। তবে কি এই জাগতিক পৃথিবীতে সুখের খোঁজ পায় ধার্মিকরা তুলনায় বেশি একজন যুক্তিবাদী নাস্তিকের থেকে? এই ঘটনাটি এইবার একটু তলিয়ে দেখা যাক। আচ্ছা “সুখ” কথার অর্থ কি? মনোবিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শনগত দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা বিভিন্ন সময়ই নির্ধারণ করার চেষ্টা হয়েছে তবে মনোবিজ্ঞান বলছে সুখকে ইতিবাচক কর্ম ও আবেগসমূহের সমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এছাড়া ও তিনটে বিশেষ অবস্থাকে ও বিবেচনা করা হয় – আনন্দ, অঙ্গীকার ও অর্থ। অন্তত মনোবিজ্ঞান তাই বলছে। এইবার আমরা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধফলকে যদি একটু যাচাই-বাছাই করি তবে দেখব সুখ প্রধানত নির্ভর করে বিভিন্ন জাগতিক ও লৌকিক অবস্থানের ওপর তা আর্থিক, পারিবারিক বা সামাজিক যে কোন পরিস্থিতিরই ওপর হোক না কেন। আমরা জানি আমাদের এই জাগতিক পৃথিবীতে এমন কিছু সময় আসে আমাদের জীবনে যার ফলে এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি করে যা আমাদের মানসিক অবস্থাকে নেতিবাচক অর্থে নাড়া দেয় যার ফলে আমাদের শরীরে কিছু নেতিবাচক হরমোন ক্ষরণ হয় তাঁর ফলে অসুখী নামক মানসিক পরিস্থিতির স্বীকার হই। এইবার এই সুখী ও অসুখী নামক যে মানসিক অবস্থান তাকে একটু বিচার করা যাক।
আমরা যদি এই পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখব, প্রকৃতি আদতে একটি প্রাণহীন নির্জীব জড়, যার কোনও ভালো-মন্দ, সুখ-অসুখ, ন্যায়-অন্যায়, অবিচার-সুবিচার, পাপ-পূণ্য বলে কোন নির্দিষ্ট সিস্টেম নেই প্রকৃতির মধ্যে। এই ধারণাগুলি আদতে মানব সমাজের বানানো নিয়ম, মনুষ্যসৃষ্ট। কেন মনুষ্যসৃষ্ট? কারন ডারউইনীয় মতে, প্রাণীর উদ্দেশ্য হল বংশবিস্তার সুতরাং, উন্নত মস্তিস্কের প্রাণী হিসেবে মানুষ তাঁর বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে তাঁর চারপাশে এমন এক পরিবেশ গঠন করেছে, যা তাঁর চারপাশে এক অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে ও এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে প্রাণীর বংশবিস্তারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, বিচার-অবিচার এইসব ধারণা মনুষ্যসৃষ্ট এবং মানুষ তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ ফলকে বিচার এই ধারণা মনুষ্য সমাজে নিয়ে এসেছে, কারণ তাঁর বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে অনুকূল পরিবেশ চাই এবং সেই পরিবেশ যদি উপরোক্ত নিয়ম-কানুন দ্বারা শৃংঙ্খলিত না হয় তবে মানবসমাজে এক বিপর্যয় নেমে আসবে এবং তাঁর বংশবিস্তারের ধারায় সংকট তৈরি করবে। যেহেতু মানুষ বিবর্তনের ধারায় একটি উন্নত মস্তিস্ক পেয়েছে তাই তাঁর বংবিস্তারের জন্য সমাজ এবং তাঁর নৈতিকতা নামক একটি সুশৃংঙ্খল ধারণা ও তৈরি করেছে। এমনি কিছু নৈতিকতার ধারণা অবশ্য কিছু প্রাণীদের মধ্যেও পাওয়া যায়, কিন্তু তা খুবই কম পরিমাণে কারন তাঁদের ছোট মস্তিষ্কের জন্য কারণ মস্তিষ্ক যত বড় হয়, তাঁর চিন্তার শক্তি ও তত বৃদ্ধি পায়। আমরা যারা যুক্তিবাদের চর্চা করি তারা এও জানি যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উৎপত্তির কারণ। প্রাচীন মানুষ ঝড়-ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, ভূমিকম্প, বন্যা প্রভৃতি যখন হত তারা এগুলি কেন হয় যেহেতু জানত না, তাই তারা ভাবতো নিশ্চয়ই এগুলি কোন অলৌকিক শক্তি তাঁর দ্বারা এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ন্ত্রিত হয়, এই ধারণা থেকেই তারা বিভিন্ন ঈশ্বর নির্মাণ করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে। এইবার ঘটনা হল, এইসব কাল্পনিক ঈশ্বরের ধারণা মানুষ যুগ যুগ ধরেই ডিএনএতে ধারণ করে এসেছে এবং বংশপরম্পরায় এই ঈশ্বরের শিক্ষা তাঁর প্রজন্মোত্তর প্রজন্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে এসেছে কিন্তু কেন? কারণ সেই ডারউইনের তত্ত্ব, প্রাণীর একমাত্র লক্ষ্য বংশবিস্তার, আর উন্নত প্রজাতির প্রাণী হিসেবে মানুষ, তাঁর এই বংশবিস্তারের জন্য সমাজ নিয়ম বিচার বানিয়ে এই বংশবিস্তারের পথকে আরো সুগম করার চেষ্টা করেছে দিনের পর দিন। এই বস্তুবাদী দুনিয়ায় বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মানুষকে, যার ফলে মানব মস্তিস্ককে পজিটিভ ও নেগেটিভ হরমোনের ক্ষরণ সহ্য করতে হয়।
এইবার পজিটিভ হরমোন ক্ষরণ হলে, মানুষ সুখী অনুভব করে এবং নেতিবাচক হরমোন ক্ষরণ হলে মানুষ অসুখী অনুভব করে, এবং সুখী-অসুখী এটি সম্পুর্ণ একটি Mental State। এইবার আমরা জানি,মানুষ আদতে কখন অসুখী থাকতে চায় না। সে সুখী জীবন-যাপন করতে চায়। কিন্তু আমাদের এই জাগতিক লৌকিক পৃথিবীতে এবং তাঁর প্রকৃতির মধ্যে আসলে সুখী থাকার কোন নিয়ম নেই কারণ এই প্রকৃতি একটি নিজস্ব নিয়মে চলে। প্রকৃতির মধ্যে কোনও ভালোমন্দ বিচার অবিচার নেই, এমন কি মানুষ বাদে আর প্রাণীকুলের মধ্যে এই ধারণার কোনও অস্তিত্ব নেই, এই ভালো-মন্দ, বিচার-অবিচার ন্যায়-অন্যায় ধারণাটি একমাত্র Human Mind-এর একটি ধারণা। সে তাঁর উন্নত জীবনের জন্য এই ধারণাকে নিয়ে এসেছে কারন বংশবিস্তারের জন্য যা আগেই বলেছি। এইবার প্রকৃতিগত ভাবে সুখী থাকার জন্য মানুষ যখন বিভিন্ন জাগতিক কারণে অসুখী হয়ে পড়ে, তা সে প্রাণ ভয় হোক, আর্থিক কারণেই হোক বা সামাজিক কারণেই হোক, তখন সেই মানুষ নিজের সুখ খুঁজতে, পৃথিবীতে বাঁচতে কোনও এক অলৌকিক সত্ত্বায় বিশ্বাস রাখে। তাঁদের যাবতীয় দুঃখ, মানসিক যন্ত্রণা ভয়কে সঁপে দেয় কোনও এক না দেখা অপ্রমাণিত সত্ত্বায় এবং বিশ্বাস করে সেই না দেখা অপ্রমাণিত সত্ত্বা যাকে বলে ঈশ্বর, সেই ঈশ্বর তাঁদের রক্ষে করবে। এবং এমন বিশ্বাসে ভরসা রেখে তারা সুখী অনুভব করে, এবং পৃথিবীতে ধার্মিকদের সংখ্যা বেশী হওয়াতে স্বাভাবিক ভাবেই যে পরিসংখ্যান বলে অবিশ্বাসী নাস্তিকদের তুলনায় বিশ্বাসী আস্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক ধার্মিকেরা বেশী সুখী। যদিও আমরা জানি ধার্মিকদের এই বিশ্বাসের আদতে কোন ভিত্তি নেই।
পৃথিবীর মানব ইতিহাসে যে বড় বড় বিপর্যয়গুলি ঘটেছে বা ঘটছে তাতে কোন ঈশ্বর এসে রক্ষা করেনি বরং লৌকিক পৃথিবীর উন্নত মানব মস্তিস্কের অধিকারী মানুষেরাই রক্ষা করেছে এবং তাঁর সবচেয়ে বড় প্রমাণ তথাকথিত ঈশ্বরের দেবভূমি যোশীমঠ ডুবে যাচ্ছে প্রকৃতির রোষে অথচ কোনও ঈশ্বর এসে তা রক্ষা করছে তো নয়ই বরং মানুষই এসে তাকে উদ্ধারের কাজে নেমেছে। সুতরাং ধার্মিক মাত্রই সুখী এটা ধার্মিকদের নিজস্ব ধারণা, তবে বাস্তব পৃথিবীতে তাঁর কোনও বাস্তবসম্মত প্রমাণ নেই।